ঘরের শত্রু চিনতে পারছে না আওয়ামী লীগ

মমমমমমম:::

সারা দেশে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। দুই দফায় ১ হাজার ১৯৮টি ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শেষ হয়েছে। ২৮ নভেম্বর তৃতীয় এবং ২২ ডিসেম্বর চতুর্থ দফা নির্বাচন হবে। নির্বাচন আমাদের দেশের মানুষের কাছে উৎসবের মতো। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনকে তামাশায় পরিণত করায় মানুষের উৎসাহে কিছুটা ভাটা পড়েছে। ভোট নিয়ে গত কয়েকটি নির্বাচনে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা খুব ভালো নয়। তাই ভোট নিয়ে মাতামাতিও কমে এসেছে। তবে এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে যেসব জায়গায় ভোট হচ্ছে, সেসব জায়গায় ভোটাররা যাঁর ভোট তিনিই দিতে পারছেন। পছন্দের প্রার্থীও বেছে নিতে পারছেন। এটা একটি ভালো লক্ষণ। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাঁকে খুশি তাঁকে দেব’–এই দাবিতে আমাদের দেশে আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু গত কয়েকটি নির্বাচনে অনেকেই পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেননি। এমনকি অনেকের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ারও প্রয়োজন হয়নি।

তবে এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিনা ভোটে জয়ের ঘটনাও কম ঘটছে না। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আগে দলীয় মনোনয়নে দলের প্রতীকে হতো না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনই শুধু দলীয় ভিত্তিতে হতো। ২০১৬ সাল থেকে স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনও দলের মনোনয়ন এবং দলের মার্কায় হচ্ছে। এটা ভালো হয়েছে, না খারাপ—তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সরাসরি অংশগ্রহণ করছে না; অর্থাৎ বিএনপির মনোনয়নে ধানের শীষ মার্কা নিয়ে কেউ নির্বাচনের মাঠে নেই। তবে বেনামে বিএনপি নির্বাচনের মাঠে আছে, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিএনপির বেশ কয়েকজন চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিতও হয়েছেন। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে বিএনপির ৬৪ জন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে। প্রথম দফায়ও নিশ্চয়ই এভাবে নির্বাচিত হয়েছেন কেউ কেউ, কিন্তু হিসাবটা আলাদাভাবে পাইনি। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনে অংশ নিলে ফল একেবারে খারাপ হতো বলে মনে হয় না।

এবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দুই ধাপে ২৫৩ জন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছেন। জোরজুলুম করেও কারও কারও প্রার্থিতা প্রত্যাহার করার অভিযোগ আছে। এই যে বিনা ভোটে জিতে যাওয়া—এটা কোনোভাবেই ভালো বা সুস্থ প্রবণতা নয়। একে নির্বাচন বলা যায় না। এটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতির পরিপন্থী। এই চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে গণতন্ত্র নিয়ে বড় কথা বলা অর্থহীন প্রলাপের মতোই শোনাবে।

বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েও আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে ‘বিদ্রোহ’ দমনে সফল হয়নি। দল থেকে বহিষ্কারের হুমকি, ভবিষ্যতে আর কখনো মনোনয়ন না পাওয়ার হুমকি—কোনো কিছুই বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া থেকে অনেককেই বিরত রাখা যাচ্ছে না। প্রথম দফা নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়েও ২৬ শতাংশ প্রার্থী পরাজিত হয়েছেন। দ্বিতীয় দফায় ৪২ শতাংশ নৌকার প্রার্থী হেরেছেন, বিদ্রোহীরা জিতেছেন। ১ হাজার ১৯৮ ইউনিয়নের মধ্যে ৪২৪টিতে নৌকা হেরেছে। ১৩১টি ইউনিয়ন পরিষদে নৌকা কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিল না। বেশ কয়েকজনের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী হয়েও এমন পরাজয় কি আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের জন্য চিন্তার কারণ নয়?

যদি বিএনপিসহ অন্য আরও কিছু রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করত, তাহলে পরিস্থিতি কেমন হতো তা কি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ভেবে দেখছেন?

বিএনপির শক্তি-সামর্থ্য নিয়ে আওয়ামী লীগের অনেকেই টীকাটিপ্পনী কেটে আনন্দ অনুভব করে থাকেন। বিএনপি দুর্বল হয়েছে, তারা শুধু হুংকার দিতে পারে, বাস্তবে কিছু করার মুরোদ নেই। কিন্তু এই দুর্বল বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন বর্জন করেও আওয়ামী লীগ প্রার্থীদের মুখের হাসি কেড়ে নিতে পারছে, এটাকে খাটো করে দেখা কি ঠিক? প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়েও এত বেশিসংখ্যক প্রার্থীর হেরে যাওয়ার কারণ কী?

য়েছেন। আবার না-পাওয়ার অংশে যাঁরা আছেন, তাঁদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়েনি, সৌভাগ্য রজনীর দেখা না পাওয়ায় তাঁরা হতাশ। ফলে অনেক কিছু পাওয়ার দলের বিরুদ্ধে কিছু না-পাওয়ার দলের ক্ষোভ-অসন্তোষ আছে। ইউপি নির্বাচনে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যাচ্ছে।

ইউপি নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নে ব্যাপক বাণিজ্য হয়েছে বলেও প্রচার আছে। টাকার লেনদেন হওয়ায় প্রার্থী মনোনয়ন যথাযথভাবে হয়নি। মন্ত্রী-এমপিদের পছন্দের লোকদের মনোনয়ন দিয়ে তৃণমূলে অসন্তোষ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ভুল প্রার্থী বেছে নেওয়ার প্রধান কারণ অর্থের বিনিময়ে অযোগ্য বা নানা কারণে এলাকায় নিন্দিত, সমালোচিত ব্যক্তিদের নাম কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। দুর্নীতির অভিযোগে চেয়ারম্যান পদ থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল কিংবা উপজেলা থেকে সুপারিশ পাঠানো হয়নি—এমন কেউ কেউ মনোনয়ন পাওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই এলাকায় বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। নৌকা পেলেই বা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেই জয় নিশ্চিত–এই ধারণা থেকে নৌকা অথবা দলের মনোনয়ন পাওয়ার প্রতিযোগিতা এমন বেপরোয়া আকার ধারণ করতে আগে কখনো দেখা যায়নি। একইভাবে নৌকা থেকে যাঁরা বঞ্চিত হয়েছেন, তাঁরা এক জোট হয়েছেন নৌকা ডোবানোর জন্য। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিদ্রোহী প্রার্থীদের কেউ কেউ মন্ত্রী, এমপি কিংবা দলের প্রভাবশালী নেতাদের মদদও পাচ্ছেন। একেকটি ইউনিয়নে পাঁচ-ছয়জন চান। মনোনয়ন পান একজন। মনোনয়নবঞ্চিতরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মনোনয়ন যিনি পান, তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা রটাতে লেগে যান।

মনোনয়ন পাওয়ার জন্য এক-দেড় কোটি টাকা খরচের কথাও শোনা যাচ্ছে। এত মোটা টাকা দিয়ে যাঁরা মনোনয়ন কিনছেন, তাঁরা জয়ী হওয়ার জন্যও সব ধরনের চেষ্টা করবেন—এটাই স্বাভাবিক। আর এ জন্য এবারের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনাও কম ঘটছে না। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ বিরোধের জন্য হানাহানি, মারামারি বেশি হচ্ছে। আহত-নিহতের সংখ্যা প্রতিটি দফার নির্বাচনে বাড়ছে।

শেষ পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কতজনের প্রাণ যাবে, কতজনকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে, তা কে বলতে পারবে? ক্ষমতার লিপ্সা কতটা ভয়ংকর হতে পারে, তা টের পাওয়া যাচ্ছে এই নির্বাচনে। নিজ দলের লোকেরা নিজ দলের লোককে হত্যা করছে, আহত করছে, ঘরবাড়ি, দোকানপাট ভাঙচুর-লুটপাট করছে। মামলা হচ্ছে, জেলেও যেতে হচ্ছে।

কিন্তু শান্তি ফিরে আসছে না। একে অপরকে রাজাকার, অনুপ্রবেশকারী, হাইব্রিড বলে গালাগাল করছে। নানা ধরনের অভিযোগের স্তূপ জমা হচ্ছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তরে। এসব কথা দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও প্রকাশ্যেই বলেছেন।

এসব কারণেই কেউ কেউ এটা বলেন যে, আওয়ামী লীগের দুশ্চিন্তার কারণ বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগের দুশ্চিন্তার কারণ আওয়ামী লীগই। বাইরে শত্রুর খোঁজে অযথা গলদঘর্ম না হয়ে, আওয়ামী লীগ যদি এখনই ভেতরের শত্রু চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী সাংগঠনিক কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে মনোযোগ না দেয়, তাহলে পরেপস্তাতে হবে।

স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করছি আমরা। এই উদ্‌যাপনের সময় কেবল সবকিছুতেই উচ্ছ্বসিত না হয়ে একটু আত্মসমালোচনা, আত্মসমীক্ষা করা প্রয়োজন। রাজনীতি একসময় ছিল জনকল্যাণের ব্রত। এখন সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু মানুষের ভাগ্যবদলের সিঁড়ি। যে গাছ লাগানো হবে ফল তো তারই হবে। আমগাছে তো কাঁঠাল হবে না! আমাদের আচরণ ও প্রত্যাশার অসংগতি দূর করতে এখনই সঠিক পথের সন্ধান করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *